স্বর্গীয় বিভাসচন্দ্র দে মহাশয়ের মাতৃদেবীকে ঠাকুরের তিনটি আশ্বাসঃ-

স্বর্গীয় বিভাসচন্দ্র দে মহাশয়ের মাতৃদেবীকে ঠাকুরের তিনটি আশ্বাসঃ-

সকালবেলা ঠাকুরমহাশয় এসেছিলেন স্বর্গীয় বিভাসচন্দ্র দে মহাশয়ের বাড়িতে ঢাকা জেলার গ্রামে। ঘটনাটি এক দশকের শেষের দিকের। বিভাসবাবুর মা উল্লসিত হয়েছেন ঠাকুরমহাশয়ের আগমনে। তিনি তাড়াতাড়ি ঠাকুরমহাশয়ের বসবার ব্যবস্থা করলেন। ইতিমধ্যে খবর পেয়ে ঐ বাড়ির অন্য ঘরের নর-নারীরাও এসে উপস্থিত হলেন। ঠাকুরমহাশয় সকলের কুশল সংবাদ নিলেন, তাহারাও প্রসন্নচিত্তে অনেকক্ষণ থাকার পর নিজ নিজ গৃহে চলে গেলেন।


জ্যৈষ্ঠ মাসের দিন অনেক রকমের আমই খাটের তলায় রয়েছে। সেখান থেকে কিছু আম বেছে নিলেন বিভাস-জননী। ভাল করে আমগুলো ধুয়ে নিলেন এবং ছেঁকে নিলেন আমের আঁশ মুক্ত করার জন্য। জামবাটি ভরা শুধু আমের রস তিনি ঠাকুরমহাশয়ের সামনে রাখলেন। ঠাকুরমহাশয় ধীরে ধীরে কিছুটা আমের রস গ্রহণ করে রসভরা জামবাটিটি তুলে দিলেন বিভাসবাবুর মায়ের হাতে।



আমের রস করতে করতে বিভাসবাবুর মা কাতর কন্ঠে ঠাকুরমহাশয়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে তার পুত্র কি কিছু একটা করে উপার্জনের পথ খুঁজে পাবে? মৃদুহাস্যে ঠাকুরমহাশয় তখন বলেছিলেন, পুত্রের উপার্জনের জন্য তিনি যেন কোনও চিন্তা না করেন। ভবিষ্যৎ জীবনে বিভাসচন্দ্রের হবে প্রচুর ধনাগম। এতক্ষণ বিভাসচন্দ্র মায়ের পাশেই বসেছিলেন --ঠাকুরমহাশয়ের সামনে। আশ্বাসবাণীতে আনন্দিত হলেন বিভাসচন্দ্র খুবই, কিন্তু ভেবে পাচ্ছেন না তিনি কী করবেন, কোথা থেকেই বা তার জীবনে ধনাগম হবে এবং সে কবে?

উদ্বেগাকুল বিভাসবাবুর মা ঠাকুরমহাশয়ের কাছে জানতে চাইলেন যে তিনি কি উপার্জনক্ষম বিভাসচন্দ্রকে রেখে যেতে পারবেন?
সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরমহাশয় উত্তর দিলেন, "হঃ পারবেন।
" সাহসের উপর নির্ভর করেই তিনি পুনরায় প্রশ্ন করলেন, "আমার কি তীর্থস্থানে মৃত্যু হবে?"
"হঃ হইব"। ঠাকুরমহাশয় বললেন।
সঙ্কোচের সঙ্গে তিনি তৃতীয় প্রশ্নও করে বললেন, " আমার মরণের ক্ষণে আপনের কি দেখা পাব? ঠাকুরমহাশয় উত্তর দিলেন, "হ, আপনি পাইবেন।"



জ্যৈষ্ঠের অগ্নিঢালা দ্বিপ্রহর, কিন্তু বিভাসচন্দ্রের মা বড় শীতল বোধ করছিলেন, এ যেন কোনও ফাল্গুন দিন তার ঘরে ঘুরছে। তিনিও বারে বারে স্মরণ করছেন ঠাকুরমহাশয়ের আশ্বাস বাণী।
বৈকাল হওয়ার কিছু পূর্বেই ঠাকুরমহাশয় সস্তা দামের সুতীর চাদরখানা গায়ে জড়িয়ে নিলেন এবং রিক্তপদে পথ চলতে আরম্ভ করলেন, চার গ্রাম দূরের কোনও বাড়িতে যাওয়ার জন্য। মাতা-পুত্রের সানুনয় অনুরোধ ঠাকুরমহাশয় সস্নেহে উপেক্ষা করলেন, জানালেন চার গ্রাম দূরের ঐ বাড়িতে আজ যাওয়ার কথা পূর্বেই তিনি জানিয়ে রেখেছিলেন। তাই বাধ্য হয়েই তাঁকে যেতে হচ্ছে। এজন্য তারা যেন মনক্ষুণ্ণ না হন।


কয়েক বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। বিভাসচন্দ্রের জীবন নাট্যে এসেছে অনেক পরিবর্তন। প্রমত্তা পদ্মানদী বিধৌত, শান্ত-ছায়া শীতল গ্রাম্য জীবন ছেড়ে তিনি এসেছেন উত্তাল-উদ্দাম সমুদ্রতীরে-পুরীধামে। আপন জননী ও সহধর্মিণীকে নিয়ে বাসা ভাড়া করেছেন পুরীতে। জগন্নাথ মন্দিরের উত্তরে অনেকটা দূরে তৈরী করেছেন তার ইটখোলা। সকালে বাজার সেরে কিছু মুখে দিয়ে বেরিয়ে পড়েন ইটখোলার উদ্দেশ্যে। দ্বিপ্রহরে এসে মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে চলে যান ইটখোলায়। ফিরে আসেন আবার রাতে শ্রান্ত-ক্লান্ত দেহ নিয়ে। একজন সহকর্মীর অভাব ইদানীং বিভাসবাবুর তীব্র হয়ে উঠেছে। সঙ্গে কেউ থাকলে পরিশ্রম অনেক লঘুবোধ করতেন, কিন্তু কোথায় পাবেন সেরকম লোক। পুরীধামে তিনি নবাগত। পরিচিতের সংখ্যা এখনও নগন্য। এ অবস্থায় কঠোর পরিশ্রম ছাড়া আর উপায়ান্তর নাই।
কয়েকদিন পর রাত্রিতে ফিরে এসে বিভাসবাবু দেখলেন, ঠাকুরমহাশয় তার পুরীর বাসা বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছেন। প্রাণভরে তিনি ঠাকুরমহাশয়কে প্রণাম করলেন বারংবার। ব্যবসার কথা তিনি আদ্যপান্ত খুলেই বললেন। সব শুনে ঠাকুরমহাশয় বললেন যে শ্যামবাবু তো পুরীতেই থাকেন। তিনি বড়ই অসুবিধায় কাল কাটাচ্ছেন। তিনি যদি বিভাসবাবুর সঙ্গে থাকেন তাহলে উপকৃত হবেন উভয়েই।

শ্যামবাবু ও বিভাসচন্দ্রের পূর্ব পরিচিত। তিনি এলে তো খুবই ভাল হয়। কাল সকাল বেলায়ই বিভাসচন্দ্র যাবে শ্যামবাবুর কাছে ঠাকুরমহাশয়ের প্রস্তাব নিয়ে--একথা তিনি জানালেন ঠাকুরমহাশয়কে। বিভাসবাবুর মা নিকটেই বসেছিলেন। তিনিও আনন্দিত হলেন এবং বললেন, "লোকই লক্ষ্মী। বিভাসচন্দ্র যেন ঠাকুরমহাশয়ের কথা মতই চলে তাহলেই সব বাধা বিঘ্ন দূর হয়ে যাবে।" পরের দিন সকাল বেলা বিভাসবাবু শুধু শ্যামবাবুর সঙ্গে কথাই বলেননি, তাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন ঠাকুরমহাশয়ের কাছে। আর শ্যামবাবু ও ঠাকুরমহাশয়ের সাথে সাক্ষাতের জন্য আসেননি তিনিও তার বিছানাপত্র সব কিছু নিয়ে এখানে বাস করতে এসেছেন স্থায়ীভাবে।

সেদিন থেকেই শ্যামবাবু ও বিভাসবাবু একই সঙ্গে ইট খোলায় যাতায়াত এবং কাজকর্ম শুরু করে দিলেন।সে দিনটাও ঠাকুরমহাশয় বিভাসবাবুর বাড়িতেই দিন-রাত্রি অতিবাহিত করলেন এবং পরের দিন অতি প্রত্যুষে ঠাকুরমহাশয় অন্যত্র চলে গেলেন।
কিছুকাল কাটার পরে শ্যামবাবুর সাহচর্য্যে বিভাসবাবু ব্যবসায়ে আরামবোধ করতে আরম্ভ করলেন, ইট খোলার কাজ ক্রমশঃ উন্নততর হতে আরম্ভ করল। আশার আলো দেখতে পেলেন বিভাসচন্দ্র, অবসর সময়ে তিনি শ্যামবাবুর সঙ্গে গল্প করেন আর তাতে পরিশ্রম লঘু হয়ে আসে।

বিভাসবাবুর মা একদিন প্রস্তাব করলেন যে শ্যামবাবু ও তার ছেলে দোতলায় থাকবে আর তিনি বধূমাতাকে নিয়ে --একতলায় থাকবেন। কারণ বারবার সিঁড়ি ভেঙ্গে ওঠানামা করা তার পক্ষে ক্রমশঃ ক্লেশকর হয়ে উঠেছে এই বৃদ্ধ বয়সে। সেই থেকে শ্যামবাবু আর বিভাসচন্দ্র থাকেন দ্বিতলের ঘরে আর বিভাস-জননী ও বিভাস-সহধর্মিণী থাকেন নীচের তলায়।

একদিন মধ্যরাত্রে বিভাসবাবুর স্ত্রী অনুভব করলেন যে মাতা ঠাকুরাণীর শ্বাসকষ্ট আরম্ভ হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দোতলায় যাচ্ছিলেন ওদের খবর দিতে। পুত্রবধূকে শয্যাত্যাগ করতে দেখে তিনি জানতে চাইলেন তার বৌমা কোথায় যাচ্ছে। উত্তরে বধূমাতা জানালেন তার ছেলেকে খবর দিতে। আস্তে আস্তে তিনি বললেন, সারাদিন ওরা পরিশ্রম করে এসেছে --একটু ঘুমোচ্ছে, এখন ওদের ডেকো না। আর আমার তো তেমন অসুবিধে হচ্ছে না। অসুবিধে যদি বেশী হয় তাহলেই বা কী করা যাবে। সকালের আগে তো কোন ডাক্তারকে পাওয়া যাবে না। নিরস্ত হলেন বধূমাতা। আস্তে আস্তে তিনি শ্বাশুরীর গায়ে হাত বুলাতে লাগলেন, কখনও বা ধীরে ধীরে পাখায় হাওয়া করছিলেন। বাইরে পাখীর কলরব শুনা যাচ্ছে--ভোর হয়ে এল প্রায়।
বিভাসবাবুর সহধর্মিণী শিয়রের জানালা দু'টি পাটই খুলে দিলেন। দেখলেন, কে একজন সরে গেলেন। ভীতকন্ঠে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, "কে? কে আপনি? কে দাঁড়িয়ে?" "আমি মা।" ----"আপনি কে?" প্রশ্ন করলেন বধূমাতা। "আমি রাম আইছি, মা।" --ভোরের আলোর সঙ্গে ভেসে এল সেই অনুচ্চ কন্ঠস্বর। তাড়াতাড়ি গিয়ে সদর দরজার খিল খুলে দিলেন বিভাসচন্দ্রের সহধর্মিণী। ঠাকুরমহাশয়কে প্রণাম করে নিয়ে এলেন শ্বাশুরীর শয্যাপার্শ্বে। এবার আর শ্বাশুরীকে জিজ্ঞাসা না করেই দ্বিতলে চলে গেলেন দ্রুত পায়ে বিভাসবাবুকে খবর দিতে যে ঠাকুরমহাশয় এসেছেন।

সঙ্গে সঙ্গে নেমে এলেন বিভাসবাবু ও শ্যামবাবু। মায়ের ঘরে ঢুকে ওরা দেখলেন যে ঠাকুরমহাশয় দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করে দিয়েছেন বিভাস-জননীর ললাটে। ঘাড় ফিরিয়ে ঠাকুরমহাশয় তাদের জানালেন, "মায় তো চইল্যা গেলেন --এইবার আপনেরা তার সৎকারের ব্যবস্থা করেন।" শোকে সাশ্রুনেত্রে ভেঙ্গে পড়লেন বিভাসচন্দ্র ও তার সহধর্মিণী। দু'টি চোখই সজল হয়ে উঠল শ্যামবাবুরও।
পুরীর সমুদ্রতীরের শ্মশান। মুখাগ্নির পরে শ্মশানবন্ধুরা ইতস্ততঃ দাঁড়িয়ে, শ্যামবাবু বিভাসবাবুকে ধরে নিয়ে বসালেন অনতিদূরে। বহ্নিমান চিতা দাউ দাউ করে জ্বলছে--ঢেউ-এর পর ঢেউ আছড়ে পড়ছে সাগরের বালুকাময় তটে আর বিভাসচন্দ্রের দু'চোখ দিয়ে ঝরছে অবিরাম অশ্রুজল।
চোখ মুছতে মুছতে বিভাসচন্দ্র বলে যেতে লাগলেন শ্যামবাবুকে, কয়েক বছর আগে ঠাকুরমহাশয় যে তাদের গ্রামের বাড়িতে কয়েক ঘন্টা অতিবাহিত করেছিলেন তার কথা--তার মাতাঠাকুরাণী ঠাকুরমহাশয়কে যে তিনটি প্রশ্ন করেছিলেন এবং ঠাকুরমহাশয় যে উত্তর দিয়েছিলেন তা তুলে ধরলেন শ্যামবাবুর সামনে।
মা জিজ্ঞেস করেছিলেন যে তিনি কি উপার্জনক্ষম আমাকে রেখে যেতে পারবেন? উত্তরে ঠাকুরমহাশয় জানিয়েছিলেন, "হঃ, পারবেন।"
দ্বিতীয় প্রশ্ন মা করেছিলেন, তার কি তীর্থস্থানে মৃত্যু হবে? ঠাকুরমহাশয় বলেছিলেন, "হঃ, হইব"।
শেষ প্রশ্নে মা কাতরকন্ঠে জানতে চেয়েছিলেন মৃত্যুর সময় কি ঠাকুরমহাশয় তার কাছে উপস্থিত থাকবেন? উত্তরে ঠাকুরমহাশয় বলেছিলেন, "হঃ, হইব।"
হাউ হাউ করে এবার ফেটে পড়লেন বিভাসবাবু বুকফাটা কান্নায়।বললেন, ঠাকুরমহাশয়ের তিনটা কথাই অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল এই ক'বছরের মধ্যে।


জয় রাম। জয় গোবিন্দ।
স্বর্গীয় বিভাসচন্দ্র দে মহাশয়ের মাতৃদেবীকে ঠাকুরের তিনটি আশ্বাসঃ- স্বর্গীয় বিভাসচন্দ্র দে মহাশয়ের মাতৃদেবীকে ঠাকুরের তিনটি আশ্বাসঃ- Reviewed by SRISRI RAMTHAKUR KOTHA O BANI YOUTUBE CHANNEL on June 29, 2021 Rating: 5

No comments:

sri sri Ramthakur

Powered by Blogger.